২০২৩ সাল’টা ক্রিকেটের জন্য একটা দুর্দান্ত বছর হিসেবে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে। বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি, অ্যাসেজের মত প্রতিদ্বন্দ্বীতা পূর্ণ টেস্ট সিরিজ চাক্ষুস করতে পেরেছেন অনুরাগীরা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ (WTC) ফাইনালে ভারত-অস্ট্রেলিয়া যুদ্ধ মন কেড়েছে দর্শকদের। এপ্রিল-মে মাসে আইপিএলের আগুনে উত্তাপ বেড়েছে অনেকখানি। পঞ্চাশ ওভারের ফর্ম্যাটেও ভারত-অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ডের মত হাড্ডাহাড্ডি সিরিজ দেখা গিয়েছে। উপমহাদেশে প্রতিদ্বন্দ্বীতার ঝড় তুলেছে এশিয়া কাপ। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ক্রিকেটজনতা বুঁদ থেকেছে বিশ্বকাপে (ICC World Cup 2023)। একাধিক ফর্ম্যাটে ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্স দিয়ে যেমন বিনোদনের পারদ চড়িয়েছেন তারকা ক্রিকেটাররা, তেমনই আশানুরূপ পারফর্ম করতে পারেন নি অনেকে। সেই ব্যর্থ তারকাদের নিয়েই গড়া হলো নিম্নলিখিত একাদশ।
Read More: অবসরের পরেও বিপুল আয় শচীন তেন্ডুলকরের, অঙ্কের হিসেবে পিছনে ফেললেন মিচেল স্টার্ককেও !!
ইমাম উল হক-
২০২৩ সালে চূড়ান্ত হতাশ করেছেন যাঁরা, তাঁদের নামের তালিকার শুরুতেই থাকবে ইমাম উল হকের (Imam ul Haq) নাম। পাকিস্তানের বাম হাতি ওপেনার সব ফর্ম্যাট মিলিয়ে ২০২৩ সালে খেলেছেন ২৩ ম্যাচ। ৩৪.২৪ গড়ে তাঁর মোট রান সংখ্যা ৮৫৬। গুটিকয় দ্বিপাক্ষিক সিরিজে রান পেলেও বড় মঞ্চে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। এশিয়া কাপে ভারতের বিরুদ্ধে করেন ১৮ বলে ৯ রান। বিশ্বকাপেও প্রথম দিকের ম্যাচগুলিতে ফখর জামানকে বাইরে রেখে ইমামের উপরেই ভরসা রেখেছিলেন প্রশিক্ষক মিনি আর্থার। কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থ হন তিনি। ৬ ম্যাচে ২৭ গড়ে কেবল ১৬২ রান আসে তাঁর থেকে। ৫০-এর উপর স্কোর নিয়ে যেতে পেরেছিলেন মাত্র একবার।
তেম্বা বাভুমা-
দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক তেম্বা বাভুমার (Temba Bavuma) নাম’ও থাকবে এই তালিকায়। বছরের শুরুটা ভালো করেছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে টেস্টে রান পেয়েছিলেন। ঘরের মাঠে দ্বিপাক্ষিক একদিনের ম্যাচেও সাফল্য এসেছিলো তাঁর ব্যাটে। ৩টি শতরান’ও করেছিলেন। কিন্তু মহাগুরুত্বপূর্ণ বিশ্বকাপে এসেই চূড়ান্ত ব্যর্থ হন বাভুমা। ব্যাটিং-এর পাশাপাশি তাঁর নেতৃত্ব নিয়েও লাগাতার প্রশ্ন উঠতে থাকে। ডি কক, রাসি ফান দার ডুসেন, এইডেন মার্করাম, হেনরিখ ক্লাসেন, ডেভিড মিলার-সদ্যসমাপ্ত বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে বড় রান পেয়েছেন একঝাঁক তারকা। ব্যতিক্রম কেবল বাভুমা। তিনি ৮ ম্যাচ খেলে ১৮.১২ গড়ে মাত্র ১৪৫ রান করেন।
বাবর আজম-
২০২৩ সালটা ভালো যায় নি পাকিস্তানের তারকা ব্যাটার বাবর আজমেরও (Babar Azam)। ২০২২ সালে যেখানে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিলো প্রায় ৫৫, সেখানে ২০২৩-এ তা নেমে এসেছে ৪০-এর নীচে। ৩৯.৯৭ গড়ে ৩৭ ইনিংসে করেছেন ১৩৯৯ রান। তিনটি শতরান করেছেন ঠিকই, কিন্তু বড় মঞ্চে আসে নি একটিও। এশিয়া কাপে একমাত্র শতক করেন নেপালের বিপক্ষে। বাকি ম্যাচগুলিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন। বিশ্বকাপেও ৯ ম্যাচে ৪০ গড়ে করেছেন ৩২০ রান। যেখানে তাঁর কেরিয়ারে ওডিআই গড় ৫৫-এর উপর, সেখানে বিশ্বকাপে বাবরের পারফর্ম্যান্স নিঃসন্দেহে হতাশাজনক। টেস্টেও ৯ ইনিংসে ২২.৬৬ গড়ে মাত্র ২০৪ রান করতে পেরেছেন তিনি। সর্বোচ্চ ৪১।
জস বাটলার-
সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জস বাটলার’ও (Jos Buttler) ২০২৩ সালে মুখ থুবড়ে পড়েছেন ব্যাট হাতে। ২০২২ সালে দুর্দান্ত ছন্দে ছিলেন তিনি। দলকে জিতিয়েছিলেন টি-২০ বিশ্বকাপ। আইপিএলেও জিতেছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের কমলা টুপি। কিন্তু বছর ঘুরতেই ফর্ম হারাতে দেখা গিয়েছিলো তাঁকে। লাল বলের ফর্ম্যাটে ইংল্যান্ড জার্সিতে দেখা যায় নি তাঁকে। সাদা বলের খেলায় ৩৩ ম্যাচে ৩৬.৯৬ গড়ে করেন ১০৯২ রান। ১টি শতরান ও ৬টি অর্ধশতক দেখা যায় তাঁর ব্যাটে। বাটলারের নেতৃত্বে নিজেদের বিশ্বকাপ ট্রফি রক্ষা করার লক্ষ্য নিয়ে ভারতে এসেছিলো ইংল্যান্ড দল। কিন্তু ৯ ম্যাচে ১৫.৩৩ গড়ে কেবল ১৩৮ রান করতে পেরেছিলেন তিনি। সেমিফাইনালের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে নি থ্রি লায়ন্স’ও।
শাকিব আল হাসান-
২০২৩-এর ফ্লপ ক্রিকেটারদের তালিকায় থাকবেন বাংলাদেশের শাকিব আল হাসান (Shakib Al Hasan)। ক্রিকেটের তিন ফর্ম্যাটেই ব্যাট হাতে বিশেষ সুবিধা করতে পারেন নি তিনি। এশিয়া কাপের ম্যাচে দ্বিতীয় সারির ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে একটি ৮০ রানের ইনিংসের বাইরে উল্লেখযোগ্য ইনিংস খেলতে পারেন নি শাকিব। তিন ফর্ম্যাট মিলিয়ে ৩৮ গড়ে ৩২ ম্যাচে তাঁর রান সংখ্যা ৯৬১। ৭টি অর্ধশতরান করলেও একবারও তিন অঙ্কের রান করতে পারেন নি বাংলাদেশ তারকা। ৩২ ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন কেবল ৩৭টি। বিশ্বকাপের আঙিনায় ৭ ইনিংসে ২৬.৫৭ গড়ে করেছেন ১৮৬ রান। উইকেট সংখ্যা ৯।
মঈন আলি-
দ্বিতীয় স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে এই তালিকায় থাকবেন মঈন আলি (Moeen Ali)। ইংল্যান্ড ক্রিকেটারের জন্যও ২০২৩ সালটা বিশেষ ফলপ্রসূ ছিলো না। ক্রিকেটের তিন ফর্ম্যাট মিলিয়ে তিনি খেলেছেন ৩০ ম্যাচ। মাত্র ২১.২১ গড়ে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ৫৯৪ রান। বল হাতেও ৩০ ম্যাচে ৩০ উইকেটের বেশী আদায় করতে পারেন নি তিনি। বিশ্বকাপের আসরে উপমহাদেশের পরিবেশেও রান পান নি তিনি। ৬ ম্যাচ খেলে করেছেন ৮৬ রান। নিয়েছেন ৫ উইকেট।
শাদাব খান-
ব্যর্থ ক্রিকেটারদের তালিকায় তৃতীয় পাকিস্তানী হিসেবে যুক্ত হবে শাদাব খানের (Shadab Khan) নাম। সীমিত ওভারের খেলায় পাক দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন শাদাব। কিন্তু নিজের নামের প্রতি সুবিচার আদৌ করতে পারেন নি তিনি। অলরাউন্ডার হিসেবে লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করেছেন শাদাব। মাত্র ২০.৭০ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ২৫ ম্যাচে ৩৫২ রান। শতরান বা অর্ধশতকের সংখ্যা শূন্য। স্ট্রাইক রেট ১০৫-এর উপর হলেও ধারাবাহিকতার অভাব স্পষ্ট ছিলো তাঁর খেলায়। এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপের মত আঙিনায় দলের মুখ্য স্পিনার হিসেবে শাদাবকে ব্যবহার করেছিলো পাকিস্তান। তিনি ২০২৩-এ ৪৪.৮০ গড়ে উইকেট নিয়েছেন মোটে ২১টি।
শার্দুল ঠাকুর-
এই তালিকায় একমাত্র ভারতীয় হিসেবে যুক্ত হয়েছেন শার্দুল ঠাকুর (Shardul Thakur)। বছরের দীর্ঘ সময় শার্দুলের ব্যাটিং দক্ষতার কথা মাথায় রেখে তাঁকে একাদশে সুযোগ দিয়েছিলেন কোচ রাহুল দ্রাবিড়। মূলত টেস্ট ও একদিনের ম্যাচে নিয়মিত খেলেছেন শার্দুল। কিন্তু বেশ হতাশাজনক পারফর্ম্যান্স তাঁর। ১৯ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। রান সংখ্যা মাত্র ১৩৬। গড় ১৩.৬০। সর্বোচ্চ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে করা ৫১ রান। বল হাতেও উইকেট সংখ্যা মাত্র ২৫। বোলিং গড় ৩০.৮৮। ওয়ান ডে ইকোনমি’ও ৬.২৬। এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপ হোক বা দক্ষিণ আফ্রিকা সফর, কোথাওই সুবিধা করতে পারেন নি শার্দুল।
হারিস রউফ-
পাকিস্তানী ফাস্ট বোলার হারিস রউফ (Haris Rauf) নিঃসন্দেহে থাকবেন এই তালিকায়। গোটা বছরে দেশের জার্সিতে ২৭ ম্যাচে ৫১ উইকেট পেয়েছেন তিনি। তা সত্ত্বেও রউফের বিশ্বকাপ পারফর্ম্যান্স মাথায় রেখে ব্যর্থ ক্রিকেটারদের মধ্যে রাখতেই হচ্ছে তাঁকে। বিশ্বকাপে ৯টি ম্যাচ খেলেছেন রউফ। উইকেট পেয়েছেন ৭টিতে। ঝুলিতে যোগ হয়েছে ১৬ সাফল্য। কিন্তু রান খরচ করছেন ৫৩৩। এক বিশ্বকাপে কোনো বোলার আগে এত পরিমাণ রান খরচ করেন নি। ইকোনমি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৭৪-এ। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চে রউফের হতশ্রী পারফর্ম্যান্স ভাবিয়েছে ক্রিকেটবোদ্ধাদের।
মাথিশা পথিরানা-
শ্রীলঙ্কার ‘বেবি মালিঙ্গা’ নামে পরিচিত মাথিশা পথিরানা’র (Matheesha Pathirana) জন্যও বছরটা কেটেছে ভালোয়-মন্দয় মিশিয়ে। আইপিএলে জাত চিনিয়েছেন তিনি। জাতীয় দলের হয়েও শুরুর কয়েকটা ম্যাচ বেশ ভালো খেলেছিলেন। কিন্তু যত সময় এগিয়েছে, ততই ফিকে হয়েছে ‘বেবি মালিঙ্গার’ জাদু। ওডিআই’তে ১২ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিলেও রান খরচ করেছেন ৭.২৭ ইকোনমি রেটে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের ম্যাচে ৯ ওভারে ৯০ রান খরচ করেছেন তিনি।
মার্ক উড-
এই তালিকায় নাম থাকবে ইংল্যান্ডের মার্ক উডেরও (Mark Wood)। নিয়মিত ১৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিতে বল করতে পারেন উড। বিশ্বকাপের আঙিনায় ইংল্যান্ড বোলিং-এর মুখ হবেন তিনি, এমনটাই মনে করা হয়েছিলো। কিন্তু চূড়ান্ত হতাশ করেছেন তিনি। ৭ ম্যাচ খেলে মাত্র ৬ উইকেট জমা পড়েছে তাঁর ঝুলিতে। বোলিং গড় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮.১৬-তে। গোটা বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অ্যাসেজে একটি টেস্ট বাদে কোনো উল্লেখযোগ্য পারফর্ম্যান্স নেই উডের। ১৩ ম্যাচের ১৬ ইনিংস মিলিয়ে তাঁর উইকেটের সংখ্যা ২৩। বোলিং গড় ৩০.৬০।