আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার রূপকার হিসেবে সকলেই একবাক্যে মেনে নেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sourav Ganguly) কথা। ২০০০ সালে যখন বাংলার ‘মহারাজের’ হাতে ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা বিসিসিআই সঁপেছিলো টিম ইন্ডিয়ার দায়িত্ব, তখন দলকে ঘিরে তৈরি হয়েছিলো এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ। ম্যাচ গড়াপেটায় জড়িয়ে বেশ কয়েকজন তারকা নির্বাসিত হয়েছিলেন। দেশের মানুষের ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার কঠিন দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। ২০০০ থেকে ২০০৫-মোট পাঁচ বছর ভারতের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই আমূল বদলে দিয়েছিলেন দলকে। অন্ধকারে নিমজ্জিত, কালিমালিপ্ত দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বচ্ছতার সর্বোচ্চ শিখরে।
সৌরভ (Sourav Ganguly) অধিনায়ক হওয়ার আগে ভারতীয় দলকে বলা হত প্রতিভাবান কিছু ব্যক্তির সমষ্টি। এককাট্টা হয়ে জয়ের জন্য ঝাঁপানোর প্রচেষ্টা অনেক সময়ই দেখা যেত না। কিন্তু বেহালার বাঁ-হাতি অধিনায়ক হওয়ার পর বদল আসে ক্রিকেট সংস্কৃতিতে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে যেভাবে তিনি তরুণ প্রতিভাদের বেছে এনে দল গড়েন তার সুফল ভারত ভোগ করেছে অন্তত এক থেকে দেড় দশক।
বীরেন্দ্র শেহবাগ, মহম্মদ কাইফ, হরভজন সিং, যুবরাজ সিং, জাহির খানদের তরুণ তুর্কি থেকে জাতীয় দলের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার যাত্রাপথটা শুরু হয়েছিলো সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরেই। এমনকি দেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়কের তকমার জন্য স্বয়ং সৌরভের (Sourav Ganguly) সাথে যাঁর জোর টক্কর চলতে পারে সেই মহেন্দ্র সিং ধোনির (MS Dhoni) মধ্যে লুকিয়ে থাকা হীরের দ্যুতি প্রথম চোখে পড়েছিলো ভারতীয় ক্রিকেটের ‘দাদা’র।
Read More: Ashes 2023: “…সেটা কি কেবল ভারতীয়দের জন্য?” বিস্ফোরক ট্যুইটে অ্যাসেজের উত্তাপ বাড়িয়ে দিলেন গৌতম গম্ভীর !!
“ধোনি কো ট্রাই করতে হ্যায়…” বলেছিলেন সৌরভ-
নয়া শতকের প্রথম দিকে ভারতীয় দলে উইকেটরক্ষক-ব্যাটারের ভূমিকায় দরকার ছিলো নতুন কোনো মুখ। পার্থিব প্যাটেল, অজয় রাত্রারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে না পারায় বাধ্য হয়েই অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) কিপিং প্যাড এবং দস্তানা হাতে তুলে নিতে অনুরোধ করেন সহ-অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়কে (Rahul Dravid)। ২০০৩ এর বিশ্বকাপেও ভারতের উইকেটরক্ষক হিসেবে দেখা গিয়েছিলো ‘দ্য ওয়াল’কে। বিশ্বকাপের পর কোনো বিশেষজ্ঞ উইকেটরক্ষককেই এই ভূমিকাই চাইছিলেন সৌরভ। লড়াই ছিলো দুই তরুণ প্রতিভার মধ্যে। তামিলনাড়ুর দীনেশ কার্তিক (Dinesh Karthik) এবং ঝাড়খণ্ডের মহেন্দ্র সিং ধোনি (MS Dhoni)। নির্বাচকেরা অধিকাংশই চাইছিলেন দলের সঙ্গে যোগ দিন কার্তিক। কিন্তু বাংলাদেশ সফরের আগে ধোনিকে খেলানোর ব্যাপারে সচেষ্ট হন স্বয়ং সৌরভই।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মহেন্দ্র সিং ধোনির (MS Dhoni) শুরুটা বিশেষ আশাপ্রদ ছিলো না। প্রথম ম্যাচে ০ রান করে রান-আউট হন তিনি। দ্বিতীয় ম্যাচে করেন ১১ বলে ১২ রান। তৃতীয় ম্যাচে আউট হন ২ বলে ৭ রান করে। ২০০৫-এর পাকিস্তান সিরিজেও ধোনিতেই আস্থা রাখেন সৌরভ (Sourav Ganguly) । কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে ৭ বলে ৩ রানের বেশী করতে পারেন নি ধোনি।
লাগাতার চার ম্যাচে ব্যর্থ হওয়ার পরেও প্রতিভাবান তরুণের হাত ছেড়ে যান নি অধিনায়ক সৌরভ। বরং আরও বেশী করে সুযোগ করে দেন তাঁকে। দ্বিতীয় একদিনের ম্যাচ ছিলো বিশাখাপত্তনমে। নিজের তিন নম্বর ব্যাটিং পজিশন ধোনিকে (MS Dhoni) ছেড়ে দেন সৌরভ (Sourav Ganguly) । অধিনায়কের আস্থার দাম দিতে ভুল করেন নি ধোনি। ১৫টি চার এবং ৪ ছক্কায় সাজান ১২৩ বলে ১৪৮* রানের ইনিংস। ভারতীয় ক্রিকেটে প্রথমবার দেখা যায় ‘মাহি ওয়ে।’
লেখক অভিরূপ ভট্টাচার্য্য তাঁর “Winning Like Sourav” Think and Succeed Like Ganguly” বইতে নেতা সৌরভের (Sourav Ganguly) মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “গাঙ্গুলীর মন্ত্র খুবই সহজসরল ছিলো। উনি যদি মনে করতেন কোনো তরুণ যথেষ্ট প্রতিভাবান, তাহলে তাঁকে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট সুযোগ দিতেন। যেটা তরুণদের জন্য প্রয়োজনীয় এক শান্ত আবহাওয়া তৈরি করেছিলো সাজঘরে। তাঁরা জানতেই একটা ব্যর্থতার পরেই তাঁদের ছেঁটে ফেলা হবে না।” এই একই বইতে ধোনির (MS Dhoni) প্রতি সৌরভের আস্থা দেখানো সম্পর্কে ভট্টাচার্য্য লিখেছেন, “যদি সৌরভ ধোনির উপর ভরসা না রাখত, তাহলে ভারত সম্ভবত এই প্রজন্মের সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটারকে হারিয়ে ফেলত।”
দলের জন্য নিজের স্বার্থত্যাগ করতে পিছপা ছিলেন না মহারাজ-
কেবল ধোনি নয়, ভারতকে বিশ্বের অন্যতম সেরা দলে পরিণত করার জন্য শেহবাগ, হরভজন, যুবরাজ, কাইফ, জাহির খান, আশিষ নেহরাদের মত বহু তরুণকে নিজের হাতে তুলে এনেছিলেন তিনি। বিশাখাপত্তনমে যেমন ধোনির (MS Dhoni) জন্য নিজের তিন নম্বর ব্যাটিং পজিশন ত্যাগ করেছিলেন, সেই একই কাজ সৌরভকে করতে দেখা গিয়েছিলো বীরেন্দ্র শেহবাগের জন্যও। শচীন-সৌরভের ওপেনিং জুটি ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা। ৫০-এর ওপর গড় তাঁদের ওপেনিং জুটির।
কিন্তু তবুও শেহবাগের (Virender Sehwag) প্রতিভাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য নিজের ওপেনিং স্লট তরুণ সতীর্থকে ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। লাগাতার ব্যর্থতায় বোর্ডের বিরাগভাজন হওয়া হরভজনকে (Harbhajan Singh) সঠিক ব্যবহার করে জিতেছিলেন ২০০১-এর ঐতিহাসিক ইডেন টেস্ট। ২০০৩-০৪ মরসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে কুম্বলেকে (Anil Kumble) দলে নিতে চাইছিলেন না নির্বাচকেরা। নিজের অধিনায়কত্ব বাজি রেখে তাঁকে দলে নিয়েছিলেন মহারাজ। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে ধরাশায়ী করে আস্থার দাম দিয়েছিলেন কিংবদন্তি লেগস্পিনার।
২০০৫ সালে কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের (Greg Chappell) সাথে বিবাদে জড়িয়ে অধিনায়কত্ব হারান সৌরভ। রাহুল দ্রাবিড়, অনিল কুম্বলের পর নেতৃত্ব হাতে পান মহেন্দ্র সিং ধোনি। তাঁর জমানায় ভারত ২০০৭-এর টি-২০ বিশ্বকাপ, ২০১১ সালের একদিনের বিশ্বকাপ, ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছে। যে ক্রিকেটাররা এই সকল খেতাব এনে দিয়েছেন দলকে, তাঁরা প্রত্যেকেই মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন সৌরভের (Sourav Ganguly) অবদান।
২০০৭-এর টি-২০ বিশ্বকাপজয়ী কোচ লালচাঁদ রাজপুত (Lalchand Rajput) সৌরভ (Sourav Ganguly) ও ধোনির (MS Dhoni) অধিনায়িকত্বের সঠিক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, “সৌরভ ক্রিকেটারদের লাগাতার আত্মবিশ্বাস যোগাতেন। উনিই ভারতীয় ক্রিকেটারদের মানসিকতায় বদল আনেন। সেই ধারাটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন ধোনি। যদি ওর (ধোনির) মনে হয় কোনো ক্রিকেরটারের মধ্যে সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে তাঁকে যথেষ্ট সুযোগ দেয় ও।”