World Cup 2023: ১৯৮৩-র লর্ডস বা ২০১১-এর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম হওয়া হলো না নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের। দেশের মাঠে বারো বছর পর কাটবে আইসিসি ট্রফি খরা-যে দৃশ্য দেখার আশা নিয়ে আজ গোটে দেশ তাকিয়েছিলো আহমেদাবাদের দিকে, বাস্তবে তার দর্শন মিললো না। বরং যে আক্ষেপ, যে হতাশার ছবিটা গত দশ বছর ধরে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের সঙ্গী, আজ বিশ্বকাপের ফাইনালেও (ICC World Cup 2023) পুনরাবৃত্তি হলো তারই। ১ লাখ ৩২ হাজার জোড়া চোখ মাঠে বসে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখলো যে দলটা গত দশ ম্যাচে নিখুঁত ক্রিকেট খেলে জায়গা করে নিয়েছে ফাইনালে, আজ খেতাবী যুদ্ধে তারাই কেমন ছন্নছাড়া, হতদ্যম। রোহিত শর্মা চেয়েছিলেন লিওনেল মেসি’র মত বিশ্বকাপ যাত্রার শেষটা ট্রফি হাতে নিয়ে করতে, কিন্তু ট্র্যাজিক নায়ক হয়েই মাঠ ছাড়তে হলো তাঁকে।
টসে জিতে প্রথমে বোলিং বেছে নিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। শুভমান গিল দ্রুত ফেরার পর রোহিত ও বিরাটের ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলো ভারতীয় দল। কিন্তু বেশীদুর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন নি রোহি-রাট জুটি। দুজনেই চেষ্টা করলেন। মিডল অর্ডারে ডুবতে থাকা তরী সামলানোর প্রয়াস চালিয়ে গেলেন কে এল রাহুল’ও। কিন্তু ফাইনালে ২৪০ রানের বেশী তুলতে পারে নি ‘মেন ইন ব্লু।’ প্রথম কয়েক ওভারের মধ্যেই ৩ উইকেট তুলে নিয়ে একটা সময় ম্যাচের দাঁড়িপাল্লা ভারতের দিকে প্রায় ঝুঁকিয়ে দিয়েছিলেন বুমরাহ ও শামি। কিন্তু ট্র্যাভিস হেডকে বাইশ গজ থেকে নড়াতে পারে নি ভারত। ২০০৩ সালে পন্টিং-এর শতরান সৌরভের ভারতের থেকে কেড়েছিলো বিশ্বকাপের ট্রফি। আজ ট্র্যাভিস হেডের আরও একটা শতক বিশ্বসেরার জয়তিলক পরিয়ে দিলো অস্ট্রেলিয়ার কপালে।
Read More: World Cup Final 2023: ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নভঙ্গ টিম ইন্ডিয়া, অজিদের কাছে ৬ উইকেটে হল পর্যুদস্ত !!
১) ফাইনালে ‘ফ্লপ’ ওপেনিং জুটি-

বিশ্বকাপের গত কয়েকটি ম্যাচে টিম ইন্ডিয়ার সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিলো তাদের ওপেনিং জুটি। ইনিংসের গোড়াতেই ধুন্ধুমার সব শট খেলে ভারতের বড় রানের ভিত গড়ে দিতে দেখা গিয়েছিলো রোহিত শর্মাকে। যোগ্য সঙ্গত করছিলেন শুভমান গিল। আজ আহমেদাবাদে ‘মেন ইন ব্লু’র সেই চেনা চিত্রনাট্য চোখে পড়ে নি। রোহিত শুরুটা নিজের হিটম্যান অবতারেই করেছিলেন। জশ হ্যাজেলউড, মিচেল স্টার্কদের বেশ কিছু বাউন্ডারিও মারেন। কিন্তু ফাইনালের চাপ সামলাতে পারলেন না শুভমান গিল। তরুণ তুর্কি আউট হলেন মাত্র ৪ রান করে। স্টার্কের বলে শর্ট আর্ম জ্যাব মারতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারান। মিড অনে বল তালুবন্দী করেন অ্যাডাম জাম্পা। ৩০ রানের মাথায় প্রথম উইকেট হারায় ভারত।
২) অতি আগ্রাসী হতে গিয়ে ফিরলেন রোহিত-

শুভমান গিল আউট হওয়ার পরেও নিজের চেনা ঝোড়ো ব্যাটিং-কে পরিত্যাগ করেন নি ভারত অধিনায়ক। ফাইনালে রোহিত শর্মার থেকে ‘ড্যাডি হান্ড্রেড’-এর অপেক্ষায় ছিলো আহমেদাবাদের এক লাখ বত্রিশ হাজার দর্শক। কিন্তু আশাহত হতে হলো তাদের। দশম ওভারের দ্বিতীয় বলটিতে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন হিটম্যান। তৃতীয় বলটিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাউন্ডারির ঠিকানায়। দুই বলে দশ রান এসে যাওয়ার পরেও রান গতিতে বাঁধ লাগাতে রাজী ছিলেন না তিনি। চতুর্থ বলে ফের স্টেপ আউট করেন। রোহিতকে এগোতে দেখে লেন্থে বদল আনেন ম্যাক্সওয়েল। ব্যাটে-বলে সংযোগ সঠিক না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত দূরত্বে বল পাঠানো সম্ভব হয় নি। শর্ট কভার থেকে দৌড়ে গিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ ধরেন ট্র্যাভিস হেড।
৩) অর্ধশতক কোহলির, পঞ্চাশের গণ্ডি পেরোন রাহুল’ও-

রোহিত শর্মা আউট হওয়ার পর ক্রিজে এসেছিলেন শ্রেয়স আইয়ার। বেশীক্ষণ ক্রিজে থাকতে পারেন নি তিনি। মাত্র চার রান করেন। এরপর ইনিংসের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বিরাট কোহলি এবং কে এল রাহুল। অস্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত ফিল্ডিং পজশনিং এবং বোলিং পরিবর্তনের কারণে বাউন্ডারি মারা কঠিন হয়ে গিয়েছিলো মাঝের ওভারগুলোয়। একটা সময় প্রায় ১৭ ওভার কোনো চার বা ছক্কা মারতে পারেন নি কোহলি ও রাহুল। অগত্যা খুচরো রানের ভরসা রাখতে হয়। ৫৪ রান করে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্লেড-অন হন কোহলি। বিশ্বকাপে তিনি থামলেন ৭৬৫ রান করে। অন্যদিকে রাহুল ৬৬ রান করলেও খরচ করেন ১০৭ বল। মাত্র ১টি চার আসে তাঁর ব্যাট থেকে।
৪) দুর্ধর্ষ বোলিং অস্ট্রেলিয়ার, নেতৃত্বে নজর কাড়লেন কামিন্স-

বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া বরাবর জ্বলে ওঠে-ক্রিকেটদুনিয়ায় বহু প্রচলিত এই প্রবাদ আজ আরও একবার সত্যি বলে প্রমাণিত হলো। বল হাতে দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখলেন স্টার্ক, কামিন্স, জাম্পা’রা। গোটা টুর্নামেন্ট বিশেষ সফল নন মিচেল স্টার্ক। আজ ফাইনালে তিনিই তুলে নিলেন তিন উইকেট। ১০ ওভারে মাত্র ৩৪ রান খরচ করে ২ উইকেট নেন অধিনায়ক কামিন্স। জোড়া উইকেট জশ হ্যাজেলউড’ও। সফল হন ম্যাক্সওয়েল, জাম্পা’ও। ভারতের হয়ে সূর্যকুমার যাদব, রবীন্দ্র জাদেজারা রান পান নি। অজি বোলারদের দাপটে ২৪০ রানে থামে ভারতীয় ইনিংস। ছন্দে থাকা ‘মেন ইন ব্লু’র উপর দিয়ে আগ্রাসনের স্টিম রোলার চালিয়ে দিয়ে স্টিভ ওয়া, রিকি পন্টিং-দের পাশে জায়গা করে নেন প্যাট কামিন্স।
৫) প্রথম স্পেলে আশা জাগিয়েছিলেন বুমরাহ-শামি-

২৪১ রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নেমেছিলো অস্ট্রেলিয়া। রান যে যথেষ্ঠ নয়, তা ইনিংসের বিরতির সময়েই জানিয়ে দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। টিম ইন্ডিয়ার প্রয়োজন ছিলো উইকেট। প্রথম বলেই ডেভিড ওয়ার্নারকে জালে তুলে নিতে পারতেন জসপ্রীত বুমরাহ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ক্যাচের জন্য প্রচেষ্টাই করলেন না কোহলি ও শুভমান গিল। এরপরেও অবশ্য সাফল্যের জন্য বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি। মহম্মদ শামি ফিরিয়ে দেন ওয়ার্নারকে। কৃত্রিম আলোর নীচে শামি-বুমরাহ’র স্যুইং আশা জাগিয়েছিলো ভারতীয় সমর্থকদের মনে। একটা সময় ব্যাট হাতে বেশ বেকায়দায় ছিলো অস্ট্রেলীয় তারকারা।
৬) বুম-বুম-বুমরাহ’তে মাতলো আহমেদাবাদ-

পরিসংখ্যান বলছিলো দ্বিতীয় ইনিংসে আহমেদাবাদের মাঠে গড় স্কোর ২০৮। যা ভরসা যোগাচ্ছিলো টিম ইন্ডিয়াকে। প্রথম দুই ওভারে রান খরচ করলেও শামি-বুমরাহ’র যুগলবন্দীতে একটা সময় ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিলো অস্ট্রেলীয় ব্যাটিং-এ। পরপর জোড়া সাফল্যও দেশকে এনে দেন বুমরাহ। তাঁর অনবদ্য আউটস্যুইং মিচেল মার্শের বাড়িয়ে দেওয়া ব্যাট স্পর্শ করে জমা পড়ে কে এল রাহুলের দস্তানায়। আর ইনস্যুইং-এ বাজিমাত করেন স্টিভ স্মিথের বিরুদ্ধে। ৪৭ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারিয়েছিলো অজি’রা। সম্প্রচারকারী সংস্থার ‘উইন প্রেডিক্টারের’ কাঁটা তখন বলছিলো ভারত এগিয়ে ৫৯-৪১ ফলে।
৭) ভারতের পথে কাঁটা বিছিয়ে দিলেন ট্র্যাভিস হেড-

আবার একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল, আবার টিম ইন্ডিয়ার বাধা হয়ে দাঁড়ালেন ট্র্যাভিস হেড। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ওভালের মাঠে প্রথম ইনিংসে হেডের দাপুটে শতরান রোহিত শর্মার দলকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছিলো। আহমেদাবাদের বিশ্বকাপ ফাইনালেও তিনিই ভারতীয় বোলিং আক্রমণকে ভোঁতা করে দিলেন একার হাতে। শামি-বুমরাহ’রা যখন স্যুইং ব্যবহার করে চাপে ফেলেছিলেন প্রতিপক্ষকে, তখন অহেতুক তাড়াহুড়ো করতে যান নি হেড। বরং সময় নিয়েছেন। পরে শিশিরের কারণে বোলিং কঠিন হয়ে পড়লে হাত খোলেন। একটা সময় চোটের কারণে বিশ্বকাপ খেলাই অনিশ্চিত ছিলো তাঁর। আজ ভারতের বিরুদ্ধে ফাইনালে শতরান করে তিনি হয়ে উঠলেন কাপ জয়ের নায়ক। ২০০৩ সালে রিকি পন্টিং-এর ১৪০ ভারতের হৃদয় ভেঙেছিলো। সেই ক্ষত নতুন করে উস্কে দিলো হেডের অনবদ্য ১৩৭।
৮) বিরাটের স্লেজিং সামলে লড়লেন লাবুশেন’ও-

৪৭ রানে অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে তখন ৩ উইকেট। স্টিভ স্মিথ আউট হতে ক্রিজে এসেছিলেন মার্নাস লাবুশেন। নবাগত ব্যাটারের উপর চাপ বাড়াতে স্লেজিং-এর পন্থা বেছে নেন বিরাট কোহলি। রীতিমত হাত পা নেড়ে লাবুশেনের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে দেখা যায় তাঁকে। ওভারের মাঝেও চলে দুজনের কথা চালাচালি। কিন্তু দিনের শেষে বিরাটের স্লেজিং ট্যাকটিক্সকে ব্যর্থই বলতে হয়। টেস্টে ক্রিজেটে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটার লাবুশেন। আজ আহমেদাবাদের কঠিন পিচে টেস্টের অধ্যবসায় নিয়েই ব্যাটিং করলেন তিনি। ট্র্যাভিস হেডের সাথে দুর্দান্ত জুটি গড়লেন ১৯২ রানের। তাঁর ব্যাট থেকে এলো ৫৮ রান। ক্রিজে টিকে থেকে লাবুশেন নিশ্চিত করলেন ৬ উইকেটের ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়ার জয়।
৯) ফিল্ডিং-এ ভারতকে টেক্কা দিলো অস্ট্রেলিয়া-

টানা দশ ম্যাচ জিতে যে আশার ফানুস শূন্যে উড়িয়েছিলো ভারতীয় দল, ফাইনালের হারে তা চুপসে গেলো আজ। দেশের মাঠের জনতার চাপ, একাধিক ফাইনাল, সেমিফাইনাল হারের কারণে তৈরি স্নায়ুর চাপ, ইত্যাদি নানা বিষয় হয়ত পরে উঠে আসবে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায়। কিন্তু দুই দলের মাঠের পারফর্ম্যান্স তুল্যমূল্য বিচার করলে দেখা যাবে ভারতের ম্যাচ খোয়ানোর অন্যতম কারণ ফিল্ডিং-এ শিথিলতা।
ম্যাচের প্রথম বল থেকে ফিল্ডিং-এ নিজেদের উজাড় করে দিতে দেখা গিয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে। বছর ৩৭-এর ডেভিড ওয়ার্নার ডাইভ দিয়েছেন অবলীলায়। প্রায় উড়ে গিয়ে ক্যাচ তালুবন্দী করেছেন ট্র্যাভিস হেড। ধারাভাষ্যকারদেরও বলতে শোনা গিয়েছে যে অন্তত ৩৫-৪০ রান ফিল্ডিং-এ বাঁচিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সেখানে ভারতীয় ফিল্ডাররা আজ ক্যাচ ছাড়লেন। বাই রান হলো প্রচুর। দিনের শেষে সবরমতীর জলে ভারতের কাপস্বপ্নের যে সমাধি হলো, তার জন্য ব্যাটিং, বোলিং-এর পাশাপাশি ফিল্ডিং-এ ‘চোকিং’-ও যথেষ্ট দায়ী।