PAK vs ENG: ২০২২ টি-২০ বিশ্বকাপের যবনিকা পতন হলো আজ। ইংল্যান্ড না পাকিস্তান? কার হাতে উঠতে চলেছে মহামূল্যবান শিরোপা? আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো গোটা ক্রিকেটবিশ্ব। ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়ন বনাম ২০১০ সালের খেতাবজয়ী’র লড়াই দেখতে মুখিয়ে ছিলো মেলবোর্ন। গ্রুপ পর্বে প্রথম দুই ম্যাচে হেরে বাইরে বিশ্বকাপের বাইরে চলে গিয়েছিলো পাকিস্তান। সেখান থেকে অবিশ্বাস্য কামব্যাক করেছে তারা। নেদারল্যান্ডস দক্ষিণ আফ্রিকা’কে হারানোয় যে লাইফলাইন পেয়েছিলেন শাহীন শাহ আফ্রিদি’রা, তা কাজে লাগিয়ে শিরোপা জিততে নিজেদের সর্বস্ব দিলেন বাবর আজম’রা। এই মেলবোর্নেই ইংল্যান্ড’কে হারিয়ে একদিনের বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছিলেন ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রম’রা। বাবর আজম, মহম্মদ রিজওয়ান’রা চেয়েছিলেন সেই সুদিন ফেরাতে। কিন্তু পারলেন না তাঁরা। এক ধাপ দূরেই থেমে গেলো স্বপ্নের দৌড়। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে চাপে ছিলো ইংল্যান্ড। সেখান থেকে দুরন্ত ক্রিকেট খেলে এম সি জি পৌঁছেছিলো তারা। সেমিফাইনালে ভারত’কে উড়িয়েছিলো ১০ উইকেটে।
কারান, রশিদে শুরুতেই কেঁপে যায় পাকিস্তান-

পাকিস্তান ব্যাটিং অনেকটাই তাদের দুই ওপেনারের ওপর নির্ভরশীল, এই কথা জানতেন সকলেই। এমনকি নিজেদের সেমিফাইনাল ম্যাচেও নিউজিল্যান্ডের রান তাড়া করতে পাক দল’কে অনেকটা ভরসা করতে হয়েছিলো বাবর আজম আর মহম্মদ রিজওয়ানের ওপর। দু’জনে করেছিলেন ১০৫ রানের পার্টনারশিপ। এক ভুল করতে রাজী ছিলেন না জস বাটলার। রিজওয়ানের বিরুদ্ধে শুরুতেই নিয়ে আসেন স্যাম কারান’কে। বাঁ-হাতি পেসারের বিরুদ্ধে তাঁর দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে রিজওয়ান’জকে আউট করেন কারান। ওপেনিং পার্টনার’কে হারিয়ে খোলসে ঢুকে পড়েন বাবর। ফর্ম নিয়ে গোটা বিশ্বকাপে ভুগেছেন তিনি। ভুগলেন আজও। ২৮ বলে মন্থর ৩২ করে আউট হন তিনি। পাকিস্তানের এক্স-ফ্যাক্টর বলা হচ্ছিলো যাঁকে সেই মহম্মদ হ্যারিস’ও ব্যর্থ আজ। নিজের দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে এসে আরও ২ উইকেট নেন কারান। ম্যাচের শেষে তাঁর বোলিং পরিসংখ্যান ৪ ওভারে ১২ রানের বিনিময়ে ৩ উইকেট। ফাইনালের নিরিখে প্রায় অবিশ্বাস্য বলা চলে। আদিল রশিদ, ক্রিস জর্ডান দু’টি করে উইকেট পান। একটি উইকেট পান বেন স্টোকস। শান মাসুদের ২৮ বলে ৩৮ আর শাদাব খানের ১৪ বলে ২০ রানের সুবাদে পাকিস্তান তোলে ১৩৭ রান। ফাইনালের জন্য যা কখনোই যথেষ্ঠ নয়।
আরও একটা ফাইনাল, আরও একবার বেন স্টোকস-

২০১৯ সালে একদিনের বিশ্বকাপ জিতেছিলো ইংল্যান্ড, ২০২২ এর মেলবোর্নেও আরও একবার উড়লো ইংল্যান্ডের পতাকা। সেমিফাইনালের মত একপেশে হলো না ম্যাচ। শেষ অব্দি চাপের মুখে মাথা ঠাণ্ডা রেখে বিশ্বকাপ জিতে নিয়ে গেলেন বেন স্টোকস’রা। উইন্ডিজের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে দ্বিতীয় বার টি-২০ বিশ্বকাপ জিতলো ইংল্যান্ড। একদিনের বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন যিনি, সেই বেন স্টোকসের হাত ধরেই কুড়ি-বিশের বিশ্বযুদ্ধেও জিত ইংল্যান্ডের। বড় মঞ্চ পেলে জ্বলে ওঠা বড় খেলোয়াড়ের বিশেষত্ব। আর বড় মঞ্চের খেলোয়াড় হিসেবে এই মুহুর্তে বেন স্টোকসের(Ben Stokes) আশেপাশেও নেই কেউ। কে ভুলতে পারে ২০১৯ একদিনের বিশ্বকাপের ফাইনালে লর্ডসে সেই মহাকাব্যিক ইনিংস? অ্যাসেজে শেষ দিনে ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি? ইংল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারের অসামান্য ক্রিকেট কেরিয়ারে আরও একটা পালক যুক্ত হলো আজ। নাসিম, হ্যারিস, শাহীন, ওয়াসিম’দের দাপটে একসময় ম্যাচ থেকে হারিয়েই গিয়েছিলো ইংল্যান্ড। ইফতিকার আহমেদের এক ওভারে ১৩ রান নিয়ে ম্যাচে ফেরান স্টোকস। ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে শেষ ওভারে ৪ ছক্কা খেয়ে বিশ্বকাপ হাতছাড়া করেছিলেন স্টোকস, আজ ম্যাচ জিতিয়ে সেই ক্ষতেও প্রলেপ দিলেন তিনি। শুরুতে হেলস(Alex Hales) ফিরে যান আজ। ভালো শুরু করেও বড় রান পান নি অধিনায়ক বাটলার( Jos Buttler,)। হ্যারি ব্রুকস ফিরতে ইংল্যান্ডের দরকার ছিলো এমন কাউকে যে শেষ অব্দি উইকেটে থেকে বৈতরণী পার করাবে দল’কে। ইংল্যান্ডের বরাবরের ত্রাতা স্টোকস সেই দায়িত্ব পালন করলেন মইন আলি’কে(Moeen Ali) নিয়ে। উনিশতম ওভারে ১৩ বলে ১৯ করে মউন ফিরলেও শেষ অব্দি উইকেটে থাকলেন স্টোকস। ৪৯ বলে ৫২ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে ইংল্যান্ডের কপালে পরিয়ে দিলেন জয়ের তিলক।
অনবদ্য লড়লেন পাকিস্তানী বোলার’রা-

দিনের শেষে বিজিতের তালিকায় লেখা থাকবে তাঁদের নাম। গলায় ঝোলা মেডেলের রঙগুলো সোনালী’র বদলে হবে রূপোলি। কিন্তু তাও ক্রিকেট রূপকথায় থেকে যাবে পাকিস্তানী বোলারদের অনবদ্য লড়াই। মতি নন্দী’র ‘কোণি’ উপন্যাসে কোচ ক্ষিদ্দা’র সেই ‘ফাইট কোণি ফাইট’ সংলাপ’টি অমর হয়ে রয়েছে। তেমন কোনো কথা ইনিংসের বিরতি’তে শাহীন-নাসিম’দের পাক মেন্টর ম্যাথু হেডেন বলেছিলেন কিনা জানা নেই তবে সবুজ ঘাসে জান লড়িয়ে দিলেন পাকিস্তানের বোলার’রা। ১৩৭ রান কখনোই যথেষ্ঠ নয়, তবুও কখনো ম্যাচ’কে একপেশে হতে দিলেন না তাঁরা। প্রথমেই অ্যালেক্স হেলস’কে ফিরিয়ে ম্যাচ জমিয়ে দিয়েছিলেন শাহীন আফ্রিদি(Shaheen Shah Afridi)। তিনে নামা সল্ট’কে ফেরান হ্যারিস রউফ(Haris Rauf)। অনবদ্য আউটস্যুইং-এ রউফ ফেরান বাটলার’কেও। মাঝের ওভারগুলো’তে নাসিম শাহ, মহম্মদ ওয়াসিম জুনিয়র’রা যখন বল করছিলেন পাল্লা প্রায়শই ঝুঁকে যাচ্ছিলো পাকিস্তানের দিকে। তাল কাটলো হঠাৎ। শাদাব খানের বলে ক্যাচ নিতে গিয়ে হাঁটুতে চোট পান শাহীন আফ্রিদি। অনেক চেষ্টাতেও আর বল করতে পারেন নি তিনি। শাহীনের পরিবর্ত ইফতিকার আহমেদের এক ওভারে ১৩ রান নিয়ে ইংল্যান্ড’কে চাপের অনিশ্চিত গলিপথ থেকে জয়ের উজ্জ্বল সরণী’তে ফেরান বেন স্টোকস। ১৯৯২ সালে ইমরান খানের হাতে একজন ওয়াসিম আক্রম ছিলো যে পরপর দুই উইকেট নিয়ে পাকিস্তান’কে জিতিয়েছিলো বিশ্বকাপ। আজ বাবর আজমের দলের নাসিম,শাহীন,রউফদের হয়ত আক্রমের পাশে বসা হলো না, তবে আজকের পারফর্ম্যান্স দেখে নিজের উচ্চাসন থেকে তাঁদের দিকে আশীর্বাদের হাত বাড়িয়ে দেবেন স্বয়ং আক্রম এ নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই।