ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে সহজ জয় পাওয়ার পর গতকাল থেকে দ্বিতীয় টেস্টে মাঠে নেমেছে টিম ইন্ডিয়া (Team India)। ডোমিনিকার উইন্ডসর পার্কে ভারত জিতেছিলো ইনিংস এক ইনিংস এবং ১৪১ রানের ব্যবধানে। ব্যাটে-বলে দাপট বজায় রেখেছিলো রোহিত শর্মার (Rohit Sharma) দল। টসে জিতে ব্যাটিং বেছে নিয়ে উইন্ডিজ আটকে গিয়েছিলো মাত্র ১৫০ রানে। স্পিনের জাদুতে তাদের মাত করেন অশ্বিন (Ravichandran Ashwin)। যশস্বী ও রোহিত শর্মার শতরানের সুবাদে ৪২১ তোলে ভারত। নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসেও অশ্বিনকে সামলাতে ব্যর্থ হয় উইন্ডিজ। ১৩০ রানে গুটিয়ে যায় তারা। ৭ উইকেট নিয়ে নায়ক হন ভারতীয় অফস্পিনার। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫ উইকেট নিয়ে যোগ্য সঙ্গত করেন জাদেজাও।
ব্যাটিং লাইন আপ এবং স্পিনাররা সফল হলেও ডোমিনিকায় সাফল্য পান নি টিম ইন্ডিয়ার (Team India) পেসার’রা। দুই ইনিংস মিলিয়ে মাত্র ২ উইকেট পান মহম্মদ সিরাজ (Mohammed Siraj)। প্রথম ইনিংসে ১ উইকেট পেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে শূন্য থাকে শার্দুল ঠাকুরের ঝুলি। আর জয়দেন উনাদকাট দুই ইনিংসে ৯ ওভার হাত ঘুরিয়ে ১৮ রান দিলেও পান নি একটিও উইকেট। ত্রিনিদাদের পোর্ট অফ স্পেনে মাঠে নামার আগে ভারতকে পেস ব্যাটারিতে কিছু বদল আনতেই হত। অনুশীলনে শার্দুল (Shardul Thakur) খানিক চোট পাওয়ায় দল নির্বাচন সহজ হয়ে পড়ে কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের জন্য। ৩০৮তম খেলোয়াড় হিসেবে টিম ইন্ডিয়ার হয়ে টেস্ট অভিষেক হয় মুকেশ কুমারের (Mukesh Kumar)। বিহারের মুকেশের অসুস্থতা, দারিদ্রকে জয় করে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানোর কাহিনী হার মানাতে পারে বলিউডের সিনেমাকেও।
Read More: WI vs IND: “তোমাকে শতরান করতেই হবে…” ম্যাচ চলকালীন মাঠের মধ্যেই বিরাটের কাছে অদ্ভুত আবদার ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারের !!
অসুস্থতা, দারিদ্রকে জয় করে মাঠে মুকেশ-

বিহারের গোপালগঞ্জ জেলার কঙ্কর কুন্দ গ্রামে জন্ম মুকেশ কুমারের (Mukesh Kumar)। বাবা কলকাতায় অটো চালাতেন। বিহারের হয়ে অনুর্দ্ধ-১৯ ক্রিকেট খেলেছেন তিনি। এরপর জীবিকার সন্ধানে ঠাঁই হয়েছিলো কলকাতায়। মুকেশের বাবা তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারের পাশে দাঁড়ান নি। বরং চেয়েছিলেন ছেলে যোগ দিন সেন্ট্রাল পুলিশ রিজার্ভ ফোর্সে। দুইবার পরীক্ষাও দিয়েছিলেন মুকেশ (Mukesh Kumar)। কিন্তু ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকা তরুণ সেনার পরীক্ষায় পাস করেন নি। অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় হাতে তুলে নিয়েছিলেন টেনিস বল। কলকাতা ও শহরতলীর খেপের ময়দানে নিয়মিত দেখা যেত তাঁকে। ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকার বিনিময়ে বল হাতে নিজেকে উজাড় করে দিতেন তিনি। সেই সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ভাবনায় জায়গা করে নিয়েছিলো পিছনের সারিতে।
ক্রিকেট কেরিয়ারকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে পারত দুরারোগ্য বোন এডেমা রোগ। হাঁটুতে তরল জমার কারণে মাঝেমধ্যেই ক্রিকেট মাঠের বাইরে চলে যেতে হত তাঁকে। চিকিৎসার খরচও বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছিলো মুকেশের পক্ষে। এই সময়েই সৌভাগ্যের সোনালী আভা দেখা যায় তাঁর সামনে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) সিএবি প্রধান থাকার সময় ২০১৪ সালে ভিশন ২০২০ নামে এক প্রকল্প চালু করেছিলেন আগামীর তারকাদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে। এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন ভিভিএস লক্ষ্মণ, মুথাইয়া মুরলীধরণও। সেখানেই ট্রায়ালে পেস বোলিং মেন্টর রণদেব বোসের (Ranadeb Bose) নজরে পড়ে যান মুকেশ (Mukesh Kumar)। প্রথম দিন ট্রায়ালে উত্তীর্ণ না হলেও মুকেশের উপর আস্থা রেখেছিলেন রণদেব।
রণদেবের কথাতেই মুকেশকে (Mukesh Kumar) সুযোগ দেয় সিএবি (CAB)। তাঁর চিকিৎসা, খাওয়া-দাওয়া, থাকার ব্যবস্থাও করে বাংলার ক্রিকেট সংস্থা। গতি, নাগাড়ে সঠিক জায়গায় বল করে যাওয়ার দক্ষতা, ঘাতক ইয়র্কার দিতে পারা মুকেশের বোলিং-এর ইউএসপি। ২০১৫-১৬ মরসুমে প্রথম যখন ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলার হয়ে মাঠে নামেন তিনি, তখন সিনিয়র পর্যায়ে ক্লাব ক্রিকেটেও একটি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা হয় নি তাঁর। কিন্তু প্রতিভাবান মুকেশ লাহলির মাঠে বীরেন্দ্র শেহবাগকে (Virender Sehwag) আউট করে ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের উইকেটের খাতা খোলেন।
অবশেষে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন পূরণ-

বাংলার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেকের পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি মুকেশকে (Mukesh Kumar)। দুইবার রঞ্জি ট্রফি ফাইনাল খেলেছেন। জায়গা পেয়েছেন ভারত-এ দলেও। নিউজিল্যান্ড-এ এবং বাংলাদেশ-এ দলের বিপক্ষে মুকেশের আগুনে বোলিং নজর কেড়েছিলো। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মারে ৩৯ ম্যাচে ২১.৫৫ বোলিং গড়ে ১৪৯ উইকেট নিয়েছেন তিনি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও বেশ সফল তিনি। ২০২২ মরসুমে দিল্লী ক্যাপিটালস (DC) শিবিরে মুকেশ যোগ দিয়েছিলেন নেট বোলার হিসেবে। নজর কেড়েছিলেন কোচ পন্টিং-এর। ২০২৩-এর ‘মিনি’ নিলামে ২০ লাখ টাকা বেস প্রাইস ছিলো তাঁর। নিলাম যুদ্ধে ৫.৫০ কোটি টাকা দিয়ে তাঁকে দলে নেয় দিল্লী (DC)। বেস প্রাইসের ২৮গুণ দাম পান তিনি। প্রথম আইপিএল মরসুমে ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ৭ উইকেট।
সিনিয়র টিম ইন্ডিয়ার (Team India) দরজাতে দীর্ঘ সময়ই কড়া নাড়ছিলেন তিনি। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একদিনের সিরিজে স্কোয়াডে ছিলেন তিনি। চলতি বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-২০ সিরিজেও ভারতীয় স্কোয়াডে ঠাঁই হয়েছিলো মুকেশের (Mukesh Kumar)। কিন্তু মাঠে নামার সুযোগ হয় নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তিন ফর্ম্যাটেই ঘোষিত দলে জায়গা পাওয়ায় মুকেশের অভিষেক নিয়ে আশাবাদী ছিলো বঙ্গ ক্রিকেটমহল। অবশেষে ত্রিনিদাদের পোর্ট অফ স্পেনে সেই সুযোগ এলো তাঁর সামনে। মহম্মদ শামি (Mohammad Shami), জসপ্রীত বুমরাহদের (Jasprit Bumrah) মত সিনিয়র পেসাররা নেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে। দ্বিতীয় টেস্টে নতুন বল হাতে টিম ইন্ডিয়া (Team India) অনেক খানি নির্ভর করবে মুকেশের (Mukesh Kumar) উপর। প্রথম ম্যাচে সাফল্যের সন্ধানে লাল ‘ডিউক’ বল হাতে তুলে নেবেন তিনি।