১৯৮৯-১৯৯০ মরসুমে শেষবার রঞ্জি ট্রফিতে সেরার শিরোপা জিতেছিলো বাংলা দল। সেই বছরই ক্রিকেটের মানচিত্রে উদয় হয়েছিলো সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক মহাতারকার। এরপর কেটে গিয়েছে প্রায় ৩৩ টা বছর। একবারও ঘরোয়া ক্রিকেটে সেরার মুকুট ফেরে নি হুগলী নদীর তীরে। বেশ কয়েকবার ফাইনালে এসে আটকেছে লক্ষ্মীরতণ শুক্ল, দীপ দাশুগুপ্তদের বিজয়রথ। স্বপ্ন দেখা থেকে অবশ্য সরে আসেন নি বঙ্গক্রিকেটের সমর্থকেরা। কখনও শাহবাজ আহমেদ, অভিমণ্যু ঈশ্বরণদের মত নতুন মুখ আবার কখনও মনোজ তিওয়ারি, অনুষ্টুপ মজুমদারদের মত বহু যুদ্ধের ঘোড়াদের ওপর ভর করে দেশসেরা হওয়ার আশা বাঁচিয়ে রেখেছেন মনের কোণে। সেই আশাপূরণের থেকে চলতি মরসুমে মাত্র এক ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে বাংলা দল। প্রাক্তন অধিনায়ক লক্ষ্মীরতণ শুক্ল’র কোচিং-এ দলকে এবার অনেক বেশী তরতাজা দেখাচ্ছে। ব্যাটে-বলে প্রতিপক্ষ’কে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়ার জন্য তৈরি যেন দলের এগারো যোদ্ধাই। মহম্মদ শামির (Mohammed Shami) মত তারকা’কে গোটা মরসুমেই পায় নি বাংলা। ভারতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সময় পান নি তিনি। এমনকি গত মরসুমের অধিনায়ক অভিমণ্যু ঈশ্বরণ’ও বেশ কিছুদিন ভারত-এ ও ভারতীয় সিনিয়র দলের সঙ্গে থাকায় খেলতে পারেন নি রঞ্জি ট্রফি। বাংলার জয়যাত্রা তাতে থমকায় নি। সুদীপ ঘরামি (Sudip Gharami),অভিষেক পোড়েল, আকাশ দীপ, মুকেশ কুমার’রা ঠিকই সামলে রেখেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের জয়পতাকা। ইন্দোরের হোলকার স্টেডিয়ামে রঞ্জি সেমিফাইনালেও অক্ষুণ্ণ রইলো সাফল্যের ধারা। মধ্যপ্রদেশকে সরাসরি হারিয়ে ফাইনালে চলে গেলো বাংলা।
২০১৯-২০ মরসুমের ফাইনালের পুনরাবৃত্তি রঞ্জি ট্রফিতে-

বাংলা বনাম মধ্যপ্রদেশ আর অন্যদিকে কর্ণাটক বনাম সৌরাষ্ট্র, এমনটাই ছিলো চলতি মরসুমের রঞ্জি ট্রফির দুই সেমিফাইনাল। উত্তেজনা দেখা গেলো দুই ম্যাচেই। গ্রুপ পর্বে মধ্যপ্রদেশের পয়েন্ট বেশী থাকায় রঞ্জির নয়া নিয়ম অনুসারে তাদের হোমগ্রাউন্ডেই সেমিফাইনাল খেলতে যেতে হয়েছিলো বাংলাকে। অ্যাওয়ে ম্যাচে গুটিয়ে যাওয়া নয়, বরং আগাগোড়া প্রতিপক্ষের ওপর দাপট দেখিয়ে ম্যাচ পকেটে পুরে নিলেন বঙ্গ ক্রিকেটাররা। টসে জিতে প্রথম ব্যাটিং বেছে নেন বাংলা অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি (Manoj Tiwary)। সুদীপ ঘরামি আর অনুষ্টুপ মজুমদারের (Anustup Majumdar) জোড়া শতরানের সুবাদে ৪৩৮ রান স্কোরবোর্ডে তোলে বাংলা দল। এরপর বল হাতে কামাল দেখান দলের পেসার’রা। আকাশ দীপ, ঈশান পোড়েল আর মুকেশ কুমারের (Mukesh Kumar) পেস ত্রয়ী এই মুহূর্তে ঘরোয়া ক্রিকেটের সেরা পেস আক্রমণ বলে মনে করছেন অনেকে। তাঁদের দাবীকে যেন মান্যতা দিলো ইন্দোরে বাংলা পেসারদের বোলিং। ৫ উইকেট তুলে নেন আকশ দীপ (Aksha Deep)। একটি করে উইকেট নেন ঈশান পোড়েল (Ishan Porel) এবং মুকেশ কুমার। দুটি উইকেট নেন শাহবাজ আহমেদ (Shahbaz Ahmed)। মাত্র ১৭০ রানে গুটিয়ে যায় মধ্যপ্রদেশ। প্রথম ইনিংসে বড় লিড পাওয়ায় বাংলার ফাইনাল খেলা প্রায় নিশ্চিতই দেখাচ্ছিলো। তবুও ভয়ডরহীন ক্রিকেটে অভ্যস্ত বাংলা দল সরয়াসরি জয়ের লক্ষ্যেই ঝাঁপায়। দ্বিতীয় ইনিংসে দ্রুত রান তুলে রজত পতিদারদের ৫৪৮ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে দেন মনোজ, শাহবাজরা। বাজবলের ঢঙে প্রায় অসম্ভব এই রান তাড়া করার চেষ্টা করলেও লাভ হয় নি মধ্যপ্রদেশের। প্রদীপ্ত প্রামাণিকের (Pradipta Pramanik) বোলিং-এ ধরাশায়ী হন বেঙ্কটেশ আইয়ার, যশ দুবেরা। ৫১ রান দিয়ে ৫ উইকেট পান প্রদীপ্ত। ৩০৬ রানে মধ্যপ্রদেশকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছায় বাংলা। একই সাথে গত মরসুমে সেমিফাইনালে হারের বদলাও নিলেন মনোজ, অভিমণ্যুরা (Abhimanyu Easwaran)। ফাইনালে বাংলার প্রতিপক্ষ সৌরাষ্ট্র। ২০১৯-১০ মরসুমে ফাইনালে চেতেশ্বর পূজারাদের (Cheteshwar Pujara) কাছেই হেরেছিলো বাংলা। এবার সুযোগ তার বদলা নেওয়ার। আগামী ১৬ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারী ফাইনাল খেলাটি হতে চলেছে বাংলার ঘরের মাঠ, ইডেন গার্ডেন্সে।
শক্তি বাড়ালো সৌরাষ্ট্র, ফিরছেন উনাদকাট-

কর্ণাটকের বিপক্ষে শেষদিনে থ্রিলারে পরিণত হয়েছিলো সৌরাষ্ট্রের রঞ্জি সেমিফাইনাল ম্যাচটি। চতুর্থ ইনিংসে মাত্র ১১৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৪২ রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়েছিলো তারা। ফাইনাল কি তবে বাংলা বনাম কর্ণাটক? এমন জল্পনা যখন দানা বাঁধছে তখন রুখে দাঁড়িয়ে দল’কে জয় এনে দিলেন অর্পিত বাসবরা (Arpit Vasavada) ও চেতন সাকারিয়া (Chetan Sakariya)। প্রথম ইনিংসে দ্বিশতরানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ৪৭ রান করেন অর্পিত। সাকারিয়া করেন ২৪ রান। শেষ অব্দি ৪ উইকেটে ম্যাচ জিতে ইডেন গার্ডেন্সে আসছে সৌরাষ্ট্র। গত বছরের শেষ দিকে বিজয় হাজারে ট্রফি জিতেছিলো সৌরাষ্ট্র দল। এবার দীর্ঘতম ফর্ম্যাটেও দেশ সেরা হওয়ার হাতছানি তাদের সামনে। সেমিফাইনালে সৌরাষ্ট্রের অধিনায়কত্ব করলেন অর্পিত বাসবরা। নিয়মিত অধিনায়ক জয়দেব উনাদকাট (jaydev Unadkat) অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জাতীয় দলের টেস্ট স্কোয়াডে থাকায় মাঠে নামতে পারেন নি। ফাইনালে পৌঁছে আরও একঝলক খুশির বাতাস খেলে গেলো সৌরাষ্ট্র শিবিরে। রঞ্জি ফাইনালে ফিরছেন উনাদকাট (Jaydev Unadkat)। ইডেন গার্ডেন্সে তাঁকে মাঠে নামার অনুমতি দিয়েছে বিসিসিআই। দিল্লী টেস্টে তঁর খেলার সম্ভাবনা বিশেষ নেই জেনেই বোর্ডের কাছে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেছিলেন উনাদকাট। তা মঞ্জুর করেছে বোর্ড। উনাদকাট ফেরায় নিঃসন্দেহে আরও শক্তিশালী হলো সৌরাষ্ট্রের বোলিং আক্রমণ। ২০১৯-২০ মরসুমে উনাদকাটের নেতৃত্বেই বাংলাকে হারিয়ে রঞ্জি ট্রফির খেতাব জিতেছিলেন শেল্ডন জ্যাকসন (Sheldon Jackson), চেতেশ্বর পূজারা’রা (Cheteshwar Pujara)। এবার টেস্ট ক্রিকেটে ব্যস্ত থাকার জন্য পূজারা নেই। তবে উনাদকাটের আগমনে চ্যাম্পিয়ন্স লাক ফেরে কিনা তা দেখতেই উদগ্রীব সৌরাষ্ট্র দলের সমর্থকেরা।