এনিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, ভারতীয় ক্রিকেটে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো কোনও তারকার উত্থান কোনও দিনই হয়নি। আজ ভারতীয় ক্রিকেট দল অন্য়ান্য় ক্রিকেট খেলিয়ে দলগুলির ওপর যেভাবে কর্তৃত্ব করছে, এর পিছনে ধোনির অবদান কোনওদিন অস্বাকার করা যাবে না। নব্বই এবং দু‘হাজার সালের প্রথম দশকে এই ছবিটা কোনওদিনই ভাবা যায়নি। আর এই কারণেই নেতা ধোনি ভারতীয় ক্রিকেটে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু, ইদানিং তাঁকে নিয়ে যেভাবে চারিদিকে সমালোচনা চলছে, ধোনির মতো একজন লেজেন্ডের যে লেগেসি, তাকেই যেন চ্য়ালেঞ্জে ফেলে দিয়েছে। ধোনি কেন অবসর নিচ্ছেন না? বা কবে অবসর নেবেন? – এইসব প্রশ্ন তাঁর মতো একজন লেজেন্ডের পক্ষে চরম অপমানজনক।
অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়ের ভারতীয় ক্রিকেট থেকে প্রস্থানের মসনদে বসেন ধোনি। ২০০৭ টি-২০ বিশ্বকাপে যেভাবে ভারত চ্য়াম্পিয়ন হয়েছিল ধোনির নেতৃত্বে, তাতে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এমন একটা টিম নিয়ে ধোনি ভারতকে বিশ্ব চ্য়াম্পিয়ন করেছিলেন, তাও আবার একটা ফরম্য়াটে – যে ফরম্য়াটে ভারতীয় দল আদৌ মানিয়ে নিতে পারবে কি না, কানাঘুঁষো চলছিল সেই সময়। কারণ, প্রথম দিকে প্রথাগত টেস্ট ক্রিকেট ও একদিনের ক্রিকেট দেখে অভ্য়স্ত বেশিরভাগ ভারতবাসীই টি-২০ ক্রিকেট নিয়ে নাক সিঁটকেছিলেন। জি কোম্পানির বিলুপ্ত হওয়া ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল) চালু না হলে টি-২০ ক্রিকেট কি তাই জানতে পারত না কেউ। আইপিএলের জন্ম হতো কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে! আজ যাঁরা আইপিএল নিয়ে মাতামাতি করছেন, তাঁদের অনেকেই বলতেন, ”এ বেশিদিন চলবে না। যতসব ফাটকা ক্রিকেট।”
রাঁচির মতো একটা ছোটো শহর থেকে উঠে এসে সর্বোচ্চ আসনে বসা, প্রথাগত সব নিয়ম ভেঙে বড় ক্রিকেটার হওয়ার চেয়েও বড় নেতা হয়ে ওঠার পথে ধোনি সফলতার পথ যত এগিয়েছেন, অনুরাগীদের পাশাপাশি, ততই নিন্দুক তৈরি করেছেন নিজের হাতে।
পাকাপাকিভাবে ভারতীয় দলের নেতৃত্ব হাতে নিয়ে বয়সের ভাবে স্লথ হয়ে যাওয়া তারকা ক্রিকেটারদের ধোনিই বাইরের দরজা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরই বক্তব্য় ছিল, ”ভারতীয় ক্রিকেটের স্বার্থে কড়া পদক্ষেপ নিতেই হবে।” ফিল্ডিং নিয়ে বর্তমান ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি যে বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন, তার সূচনা কিন্তু ধোনির হাত ধরেই। আর এর জেরেই ভারতীয় ক্রিকেটের অনেক বড় বড় তারকাকে খেলা ছেড়ে দিতে হয়েছে। সেই সমস্ত তারকাদের ভারতীয় দল থেকে কৌশলে বের করে দেওয়ার জন্য় ধোনির ওপর অনেক প্রাক্তন ক্রিকেটার ও সমালোচক বেশ ক্ষেপে। আজ তাঁরাই ধোনির দুর্দিনে জোর গলায় সমালোচনা করছেন।
যে পাঁচটি কারণে ধোনির অবসর নেওয়া উচিত!
১. বিস্ফোরক ব্য়াটিং করে অতিরিক্ত বীরেন্দ্র সেহওয়াগ নির্ভরতা কমিয়ে ভারতীয় দলে ধোনি নিজের জায়গা পাকা করেছিলেন। বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধোনি এখন আর আগের মতো সেই মার-কাটারি ক্রিকেট খেলতে পারছেন না। এই বয়সে সব বড় ক্রিকেটাররাই, আক্রমণাত্মক খেলা ছেড়ে রক্ষণাত্মক খেলার দিকে জোর দিনে এনার্জি লেভেন যাতে তাড়াতাড়ি শেষ না হয়ে যায় এবং বেশিক্ষণ ক্রিজে থাকতে পারেন। কিন্তু, ধোনির স্বার্থত্য়াগই তাঁর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে এখন। জাতীয় দলের সুবিধার্থে ধোনি তাঁর কেরিয়ারের বেশিরভাগ সময়টাই লোয়ার-মিডল অর্ডারে কাটিয়েছেন ফিনিশার হিসেবে। বয়সের সঙ্গে ধোনি তাঁর খেলাতে পরিবর্তন আনলেও, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ওই পজিশনে এই ধরনের টেকনিক অচল।
২. একশোটা স্টাম্পিংয়ের রেকর্ড গড়ে বিশ্বের সর্বকালের সেরা তিন উইকেটকিপার মার্ক বাউচার, অ্য়াডাম গিলক্রিস্ট ও কুমার সাঙ্গাকারাকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন মাহি। অধিনায়ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উইকেটকিপার-ব্য়াটসম্য়ান হওয়ার কারণে সেই সময় কেন এখনও অনেকের জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছেন ধোনি। এনিয়ে কোনও সন্দেহ নেই. ধোনি উইকেটকিপার হিসেবে যথেষ্ট ফিট এবং চটপটে। তবে, ব্য়াটসম্য়ান হিসেবে নিজের জায়গা যদি দলে মজবুত না করতে পারেন, তাহলে উইকেটকিপার হিসেবে দলে জায়গা আঁকড়ে পড়ে থাকা অর্থহীন। কারণ, ২০১৯ বিশ্বকাপের পর ধোনির পক্ষে ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে, এখন থেকেই কোনও তরুণ ক্রিকেটারকে তৈরি হওয়ার জন্য় টি-২০ ফরম্য়াটে অন্তত তাঁর খেলা ছেড়ে দেওয়া উচিত।
৩. ম্য়াচ ফিনিশারের রোলটা এখন আর তিনি আগের মতো নিতে পারছেন না। আগাগোড়া নিঃস্বার্থ ক্রিকেটার হওয়ায়, ধোনির সমস্য়া টিম ম্য়ানেজমেন্টকে নিজের স্বার্থের কথা না বলা। কারণ, ভারতীয় ক্রিকেটে একটা ব্য়াপার প্রচলিত আছে। কোনও ক্রিকেটার ত্রিশ বছরের পর দেশের স্বার্থে নিজের ক্রিকেট কেরিয়ার দীর্ঘায়িত করতে চাইলে, তাঁর নামের পাশে স্বার্থপর কথাটা জুড়ে দেওয়া হয়।
ধোনির উচিত, বিরাট ও কোচ রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা এবং ব্য়াটিং অর্ডারে চার নম্বর স্থানে উঠে আসা। তাতে তিনি থিতু হয়ে নিজের আক্রমণাত্মক খেলাটা শেষ দিকে খেলতে পারবেন। আর উইকেটে সেট হয়ে যাওয়া ধোনিকে আটকানো খুব মুশকিল বোলারদের পক্ষে। তাছাড়া, হার্দিক পান্ডিয়ার মতো তরুণ ক্রিকেটাররা ম্য়াচ ফিনিশারের জায়গা নেওয়ার জন্য় তৈরি থাকলেও, অতটা পরিণত নন। তাঁরা তাড়াতাড়ি ফিরে গেলে প্রত্য়াশার চাপটা ধোনির ওপর পড়ে যাচ্ছে।
৪. ধোনির টেস্ট ক্রিকেট থেকে ২০১৪ সালে অবসর নেওয়ার একটাই কারণ মিডিয়াতে প্রাক্তন ক্রিকেটারদের অতিরিক্ত সমালোচনা। তারপর থেকে বিরাট কোহলি দলের নেতা টেস্টের আসরে। ভালোই সামলাচ্ছেন দলকে। কিন্তু, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ধোনি চলতি বছরের শুরুতে অধিনায়কত্বের দায়ভার সমালোচনার মুখে পড়ে বিরাটের কাঁধে তুলে দিলেও, খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সেই সঙ্গে অলিখিতভাবে দলকে চালিয়ে যাচ্ছেন মাঠে। বিরাটের নামের পাশে সাফল্য়ের সংখ্য়া জুড়লেও, বিরাট কিন্তু অপিরণতই থেকে যাচ্ছেন। ধোনি যদি ২০১৯ বিশ্বকাপের পর খেলা ছেড়ে দেন বা ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে চোট-আঘাতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েন, তখন বিশ্বকাপের মতো একটা মেগা ইভেন্টে ধোনিকে ছাড়া একা হয়ে পড়বেন বিরাট। তাছাড়া, সহ-অধিনায়ক রোহিত শর্মা, তাঁকে কতটা সাহায্য় করবেন, সে নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়। কারণ, মাঠে দরকারি শলা-পরামর্শ নিতে হলে ধোনির কাছে ছুটে যান কোহলি, রোহিতের কাছে নয়। সময় থাকতে নেতা হিসেবে বিরাটক পরিণত হতে দেওয়া প্রয়োজন ভারতীয় ক্রিকেটের স্বার্থে।
৫. ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপ খেলার পরই অবসর নিয়ে নিতে পারতেন ধোনি। কারণ, তাঁর মতো একজন বড় মাপের নেতা ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের নয়, তর্কের খাতিরে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। ক্রিকেট বিশ্বে ধোনি একমাত্র অধিনায়ক যিনি আইসিসি পরিচালিত টি-২০ বিশ্বকাপ, পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ, চ্য়াম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছেন এবং টেস্টের আসরে দলকে এক নম্বর করার রেকর্ড গড়েছেন। এমন একজন অধিনায়ককে বছরের শুরুতে অধিনায়কত্ব ছাড়তে বাধ্য় করা হয়েছিল সীমিত ওভারের ক্রিকেটে, তারপর এখন যেভাবে তাঁকে অবসর দেওয়ানোর জন্য় ক্রমাগত চাপ দেওয়া চলছে, তা অত্য়ন্ত অপমানজনক। তাই ধোনির সময় থাকতে সরে যাওয়া উচিত আগামী কোনও সিরিজে বড় রকমের পারফরম্য়ান্স করে। যাতে তিনি খেলা ছাড়ার পর, সমর্থকরা বলতে পারেন, ধোনি অনায়াসে খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু, নিঃস্বার্থ ক্রিকেটার হিসেবে কোনওদিন জায়গা আগলে রাখেননি ভারতীয় ক্রিকেটে চিরকাল ব্য়তিক্রমী চরিত্র মহেন্দ্র সিং ধোনি।